আগামী ১১ জুলাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিজয়ের মধ্যদিয়ে টানা চার মেয়াদে সফলভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা করছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেষ্ঠ্যকণ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চার মেয়াদে ক্ষমতায় আসার ৬ মাসের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় সরকারের বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় থাকা দলটির তেমন কারও নাম আসেনি কোনো দুর্নীতিতে। তবে সরকারি কর্মচারীদের এসব ঘটনা সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কপালেও ভাঁজ ফেলেছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, মোটা দাগে দুর্নীতির যেসব খবর সামনে এসেছে, সেগুলো নিয়ে কঠোর অবস্থানে গিয়ে সরকার একটা বার্তা দিয়েছে এবং সেটি সরকারি দলের একটি অংশকে চিন্তিত করে তুলছে। শুধু তাই নয়, অতিদ্রুত সময়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজদের তালিকা করছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্রমতে, জাতীয় সংসদের অধিবেশন শেষ হলেই সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। পুরো জুলাই মাস ধরেই এই কর্মসূচি পালিত হবে। আগস্ট মাস শোকের মাস। শোকের মাসের আগে যেন অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিরোধগুলোর মীমাংসা হয় সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, সাংগঠনিক সফর, কর্মসূচি এবং উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা হলে এই ধরনের সমস্যাগুলো অনেকটাই কেটে যাবে। কিন্তু তারপরও যদি কেউ সমস্যা করে, কোন্দল অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেস্টা পরিষদের একজন সদস্য বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত এবং এই ব্যাপারে তিনি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিটি এলাকায় সন্ত্রাস এবং সহিংসতার জন্য নাটের গুরুদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে এই সমস্ত ঘটনার ক্ষেত্রে যারা প্রকৃত দোষী তাদেরকেই চিহ্নিত করা এবং এই দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অনেক পরের বিষয়। প্রথমে দুই পক্ষের বিরোধ কমানোর জন্য দুই পক্ষকে পাশাপাশি বসানো হবে এবং শেষ বারের মতো তাদেরকে সতর্ক করা হবে। যে সমস্ত এলাকাগুলোতে দুই পক্ষ হানাহানি করছে, তাদের নেতৃবৃন্দকে একত্রে বসানো হবে। নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে এই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তারা বিবাদমান দুই পক্ষের সঙ্গে বসবেন এবং আওয়ামী লীগ সভাপতির পক্ষ থেকে সহিংসতাা মেটানোর জন্য শেষ সতর্কবার্তা দেবেন। এই সতর্কবার্তাও যদি তারা না শোনেন তারপরেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেকজন সদস্য বলেন, সম্প্রতি যেসব দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে, সেগুলোর বেলায় সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার। এর মাধ্যমে আগামীতেও দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইনের মুখোমুখি হতে হবে, সেটিও এখন স্পষ্ট। সে কারণে আওয়ামী লীগের যারা অনিয়ম করেছেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, তারা তো চিন্তিত হবেই। তারাও ছাড় পাবে না, সেটিও পরিষ্কার। একের পর এক সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির ঘটনা সামনে আসার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দেই? এটা নিয়ে কোনও মন্তব্য করবো না। কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে সংসদে বক্তৃতা দিয়েছি, সেটিই আমার উত্তর। আর আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির কোনও খবর আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়বে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিরা সৎ হলে দুর্নীতিবাজরা পালিয়ে যাবে। বুধবার (৩ জুলাই) বিকেলে সাভারের হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এবার খেলা হবে। দুর্নীতি, অর্থপাচার, স্বৈরাচারের বিরদ্ধে। আমরা সবাই মিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বো। শেখ হাসিনার যে অঙ্গীকার, সে অঙ্গীকার আমরা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করে ছাড়ব।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। কেউ পার পাবে না। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেসেজ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ও মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখে মুখে নয়, ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। যাদের নাম আসছে, সেগুলো ধামাচাপা দিচ্ছে না সরকার। এর আগেও ক্ষমতাসীন দলের অনেক এমপিকে দুদকে যেতে হয়েছে। কিন্তু বিএনপি আমলে তো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয় এবং নিচ্ছে।
এ বিষয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নীতি বাস্তবায়নে কঠোর পথ অবলম্বন করছে সরকার। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম শুরু হয়েছে, চলবে। এ ক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না, এটা পরিষ্কার।
আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন (টানা চতুর্থবার) রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় নেতাদের একটি অংশ দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়েছে। সম্প্রতি যে কয়টি দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে, সেগুলো সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়ায় সবাই নড়েচড়ে বসেছে। দুর্নীতির খবর যখন একের পর এক সামনে আসছে, এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার গত ১৫ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার খবরও সামনে এসেছে গণমাধ্যমে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের হলফনামায় কয়েক বছরে সম্পদ বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে আসে। এমনকি উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদও কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য সামনে আসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিশ্লেষণে। গণমাধ্যম বা দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর তৎপরতা অব্যাহত থাকলে দুর্নীতিতে জড়িত দলীয় ব্যক্তিদের থলের বেড়ালও বেরিয়ে আসতে পারে শঙ্কা অনেকের। নেতারা এও বলছেন, নতুন সরকারের সামনে দুর্নীতি দমনের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বারবার বলেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ইস্যুতে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ অন্য কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অনিয়মে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, সেটি পরিষ্কার হওয়ায় ‘অপরাধীরা’ স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত হয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, চলতি বছরের শুরুতে হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তারপরও চ্যালেঞ্জিং এই নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এই সরকারের সময়ে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে এসেছে। ফলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যায় সরকার।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা শেখ হাসিনার
সন্ত্রাস-দুর্নীতিবাজদের তালিকা করছে আ’লীগ
- আপলোড সময় : ০৩-০৭-২০২৪ ১০:৩২:৫৮ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৩-০৭-২০২৪ ১১:২১:৪৬ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ